নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যকর ও সহজলভ্য পাবলিক টয়লেট একটি আধুনিক ও স্মার্ট সিটির অন্যতম প্রধান সূচক। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এক্ষেত্রে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে বেসরকারি অংশীদারত্ব বা পিপিপি মডেল অন্যতম। পাবলিক টয়লেটের নানা দিক নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন সংস্থাটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আল ফাতাহ মামুন
বাসযোগ্য নগরী গড়ার ক্ষেত্রে পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনা আপনি অগ্রাধিকারের তালিকায় কোথায় রাখেন? প্রশাসক হিসেবে এ ক্ষেত্রে আপনার মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী?
বাসযোগ্য নগরী গড়ার ক্ষেত্রে আমি পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনা শীর্ষ অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখছি। পাবলিক টয়লেট নির্মাণের জন্য খালি জায়গা পাওয়া, নির্মিত টয়লেট পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং জনসচেতনতার অভাব এগুলোই মূল চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে ডিএনসিসি এলাকায় মোট কতটি পাবলিক টয়লেট চালু আছে এবং এর মধ্যে কতটি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বা পিপিপি মডেলে চলছে? জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যা কি যথেষ্ট? আগামী এক বছরে নতুন কতটি টয়লেট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে?
১৭টি মোবাইল টয়লেটসহ মোট পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা ১২০। বেসরকারি/এনজিওর ব্যবস্থাপনায় ৪০টি পাবলিক টয়লেট পরিচালিত হচ্ছে। জনসংখ্যার তুলনায় পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। আগামী এক বছরে নতুন সাত-আটটি নতুন পাবলিক টয়লেট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
বেসরকারি সংস্থাগুলোকে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করার অভিজ্ঞতা কেমন? এ পিপিপি মডেলটি ডিএনসিসির জন্য কতটা সাশ্রয়ী এবং টেকসই প্রমাণ হয়েছে? এখন পর্যন্ত পাবলিক টয়লেট মূলত এনজিও-ভিত্তিক পিপিপি মডেলে চলেছে। যদি কোনো প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে একটি ‘টয়লেট চেইন’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদের জন্য ডিএনসিসির সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি বা মডেল আছে কি? সিটি করপোরেশন কি তাদের স্বাগত জানাবে?
বেসরকারি সংস্থাগুলোকে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করার অভিজ্ঞতা ভালো। এ পিপিপি মডেলটি ডিএনসিসির জন্য টেকসই, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব এবং ব্যবহারকারীরাও সন্তুষ্ট। যদি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে একটি ‘টয়লেট চেইন’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাব; তবে এক্ষেত্রে নির্ধারিত ফি বিদ্যমান ফির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। উল্লেখ্য, ডিএনসিসির একটি পাবলিক টয়লেট পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত নির্দেশিকা রয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত
প্রায়ই দেখা যায়, উদ্বোধনের কিছুদিন পরই পাবলিক টয়লেটের মান খারাপ হয়ে যায়। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকা টয়লেটগুলোর সেবার মান নিরীক্ষণের জন্য ডিএনসিসির কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো বা কর্মপন্থা আছে কি? মান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়?
পাবলিক টয়লেটের মান খারাপ হওয়ার কারণ হচ্ছে পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণে আন্তরিকতা ও জনসচেতনতার অভাব। বেসরকারি ব্যবস্থাপনা থাকা টয়লেটগুলোর সেবার মান নিরীক্ষণের জন্য ডিএনসিসির নিজস্ব একটি পাবলিক টয়লেট পরিচালনা নির্দেশিকা রয়েছে; যেখানে পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি সাত সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি রয়েছে এবং অঞ্চল পর্যায়ে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি আঞ্চলিক কমিটি রয়েছে। টয়লেটগুলোর সেবার মান নিশ্চিত ও সুনির্দিষ্ট কাঠামো বা কর্মপন্থা অনুযায়ী পরিচালনার জন্য ওই আঞ্চলিক পর্যায়ের কমিটি, স্থানীয় কমিউনিটি ও জনপ্রতিনিধির সমন্বয়ে মাসিক সভা হয়ে থাকে। ওই সভায় পাবলিক টয়লেটসংক্রান্ত সমসাময়িক সমস্যা সমাধান নিয়ে আলোচনা ও তা কীভাবে প্রতিকার করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তার পরও সেবার মান নিশ্চিত করতে না পারলে তার সঙ্গে চুক্তি বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
অধিকাংশ আধুনিক টয়লেটে একটি নির্দিষ্ট হারে ব্যবহারকারী ফি নেয়া হয়। এ ফি কি শুধু রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট? এ মডেলটিকে আরো টেকসই করতে বিজ্ঞাপন বা অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
অধিকাংশ আধুনিক টয়লেটে নির্দিষ্ট হারে ব্যবহারকারীদের থেকে ফি নেয়া হয়, যা দ্বারা ৫০% টয়লেটের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ-সংক্রান্ত খরচ মেটানো সম্ভব কিন্তু বাকি ৫০% টয়লেটে ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম থাকায় তাতে প্রায় সময় ভর্তুকি দিতে হয়। এ মডেলটি আরো টেকসই করতে ডিএনসিসির বিজ্ঞাপন শাখার নীতিমালা অনুযায়ী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের পরিকল্পনা আছে।
ছবি: মাসফিকুর সোহান
পাবলিক টয়লেটগুলোয় নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের নিরাপত্তা ও প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ডিএনসিসির নতুন ও পুরনো টয়লেটগুলোকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বা পরিকল্পনাধীন আছে?
নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের নিরাপত্তা ও প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ সুবিধা রয়েছে। যেমন প্রতিবন্ধী, শিশু ও বৃদ্ধদের প্রবেশ-বহির্গমনের জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুসরণে স্নোপ নিশ্চিত করে র্যাম নির্মাণসহ হাই কমোড ও হ্যান্ডরেইল ইত্যাদির ব্যবস্থা রয়েছে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরো অনেক পরিকল্পনা আছে। নতুন ও পুরনো টয়লেটগুলোকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) তথা প্রতিবন্ধী, শিশু ও বৃদ্ধ কথা বিবেচনা করে সংস্কারকাজ হাতে নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ওয়াটারএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় মহাখালী বাস টার্মিনালের অভ্যন্তরে শুধু নারীদের জন্য একটি নারীবান্ধব ‘পিংক টয়লেট’ পাইলট মডেল হিসেবে নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে, যা আগামী দুই মাসের মধ্যে উদ্বোধন করা হবে।
ঢাকা শহরের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পাবলিক টয়লেটের জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। এ স্থান সংকুলান এবং অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়দের বিরোধিতা মোকাবেলায় আপনারা কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করেন?
ঢাকা শহরের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পাবলিক টয়লেটের জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করা বেশ কঠিন তা আগেই বলা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে স্থানীয়দের বিরোধিতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সরকারি নিজস্ব জায়গায় পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করতে গিয়েও আমরা স্থানীয়দের যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হয়েছি। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ পাবলিক টয়লেটের গুরুত্ব বিবেচনা করে স্থানীয়দের বিরোধিতা মোকাবেলা করতে হবে।
‘স্মার্ট সিটি’ ধারণার অংশ হিসেবে পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনায় কোনো আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ওয়াটার-রিসাইক্লিং, ডিজিটাল পেমেন্ট বা আইওটি-ভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা যুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
‘স্মার্ট সিটি’ ধারণার অংশ হিসেবে পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনায় আধুনিক কর্মপরিকল্পনা আছে। যেমন আমরা ড. ফজলে রাব্বি পার্ক, লাউতলা পাবলিক টয়লেট ও খিলক্ষেত রেলগেট পাবলিক টয়লেটে এরই মধ্যে বায়োলজিক্যাল সেপটিক ট্যাংক বসিয়েছি। বিভিন্ন টয়লেটে আধুনিক পানির কল বসিয়েছি, যা সেন্সরের মাধ্যমে হাতের স্পর্শ ছাড়াই চলে। উল্লেখ্য, পাবলিক টয়লেটের অবস্থান সহজে খুঁজে পাওয়া এবং অন্যান্য সেবার জন্য একটি মোবাইল অ্যাপস ‘যাবো কোথায়’ তৈরি করা হয়েছে, যা শিগগিরই নগরবাসীর জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
পাবলিক টয়লেটের জন্য পানি, বিদ্যুৎ এবং পয়োনিষ্কাশন লাইন অপরিহার্য। এ পরিষেবাগুলো নিশ্চিত করতে ওয়াসা, ডেসকো বা ডিপিডিসির মতো অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ডিএনসিসির সমন্বয় কতটা সাবলীল? এক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি?
পাবলিক টয়লেট পরিচালনার জন্য সরকারি সংস্থা যেমন ওয়াসা, ডেসকো ও ডিপিডিসির সঙ্গে পানি ও বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে পয়োনিষ্কাশন লাইন যথেষ্ট না হওয়ায় আমরা এরই মধ্যে বায়োলজিক্যাল সেপটিক ট্যাংকের মাধ্যমে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখছি।
পাবলিক টয়লেটগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা কেবল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নয়, নাগরিকদেরও ভূমিকা রয়েছে। এ স্থাপনাগুলোর প্রতি মানুষের মধ্যে মালিকানাবোধ তৈরি করতে এবং তাদের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে ডিএনসিসি কোনো জনসচেতনতামূলক প্রচারণা বা উদ্যোগ নেয়ার কথা ভাবছে কি?
পাবলিক টয়লেট যথেচ্ছ ব্যবহার করার জন্য ডিএনসিসি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থা যেমন ওয়াটারএইড বাংলাদেশ, ভূমিজ, দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ স্থানীয় কমিউনিটিকে এরই মধ্যে সংযুক্ত করেছে এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণাসহ স্থানীয় কমিউনিটিদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে।